Home স্বাস্থ্য আমার জীবনে ক্যান্সার অভিজ্ঞতা

আমার জীবনে ক্যান্সার অভিজ্ঞতা

0
আমার জীবনে ক্যান্সার অভিজ্ঞতা
নাসরিন সুলতানা খানম :
“I am and I will”
“আমি আছি, আমি থাকবো”
ক্যান্সার সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য। আর আমার জীবনের প্রতিক্ষণের বাঁচার মন্ত্র, উজ্জীবনী শক্তি।
বিশ্ব ক্যান্সার সচেতনতা দিবস আমার মত অসংখ্য ক্যান্সার যোদ্ধাদের জন্য বিশেষ দিন।
মনে হলো এটি আমার বলার দিন। আমি চাই মানুষ জানুক, মানুষ বলুক। কষ্ট গোপন করে কেউ আর না কাঁদুক। এটি গোপন করার, গোপন রাখার মতো কোন বিষয় নয়। অন্যকে জানিয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরী করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কষ্টকে সবাই মিলে জয় করবো হাসিমুখে পরস্পরের সমব্যথী হয়ে এটাই চাওয়া।
২০১৯ আমার জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়া এক যুদ্ধ বছর। আমার ক্যান্সার জীবনের সংস্পর্শের বছর। জীবনে সহজে ভেঙে না পড়া মানুষ আমি। আশাবাদ আর স্বপ্ন নিয়ে চলি। সেই আমিই সেদিন কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিলাম আমার শরীরে ‘ক্যান্সার’ এমন এক অপ্রত্যাশিত খবরে।
তেমন কোন সমস্যা নেই, হঠাৎ একটু অন্যরকম ব্যথা অনুভব, ছোট মার্বেল সাইজ চাকার অস্তিত্ব এটুকুই। ভেবেছিলাম টিউমার হবে হয়তো। ক্যান্সার হতে পারে এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সচেতন ছিলাম সবসময়। এ বিষয়ক নূন্যতম ধারণা ছিলো আগে থেকেই। নিজেই প্রাথমিক পরীক্ষা করতাম। তাই লক্ষণ দেখে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় গিয়েছিলাম।
দেরী করিনি একটুও। ডাক্তার দেখালাম। প্রাথমিক পরীক্ষা -নিরীক্ষা হলো রিপোর্ট সন্দেহজনক। চলে গেলাম টাটা মেডিকেল সেন্টারে। প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা- নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানালেন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত আমি। পৃথিবীর সমস্ত শূন্যতা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। জীবন-মরণ ঘনিষ্ট অন্যরকম এক অনুভবের ক্ষণ সেটি।
ডাক্তার অভয় দিলেন, সচেতন ছিলাম বলে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আমার রোগ শনাক্ত করা গেছে। এ অবস্থায় আরোগ্যের সম্ভাবনা ৯০%। বললেন, এটি একটি লড়াই। সময় আর ধৈর্য সাপেক্ষ লড়াই। আমাকে সেই লড়াই জিততে হবে। আমার সময় আর কষ্টের সাথে লড়তে হবে। অসীম ধৈর্য লাগবে। তবুও ঐ মুহূর্তে এই খবরটি মেনে নেয়ার মতো শক্তি আমার ছিলো না। ভেঙে পড়েছিলাম আমি।
আমার হাত ছুঁয়ে থাকা প্রাণের মানুষটি আমাকে আরও শক্ত করে ধরে রেখে জানান দিয়েছিলো, এ লড়াইয়ে তুমি একা নও; আমি সাথে আছি। পরিবারের সবাই জানিয়েছিলো, সাথে আছে ভয় নেই। কিছু বন্ধু, স্বজন দূরে থেকেও প্রতিমুহূর্ত একান্ত কাছে থেকেছে, খবর নিয়েছে, সাহস দিয়েছে।
তারপর থেকে প্রতিক্ষণের লড়াই; কখনো শরীরের, কখনো মনের, আর কখনো বা শরীর-মনের। পরিবারের স্বজনরা পরম ভালোবাসা, মমতায় প্রতিক্ষণ আগলে রেখেছিলো বলে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক কোন লড়াইয়ে ভেঙে পড়তে হয়নি আমাকে। অশেষ কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি।
কিন্তু আমার মতো সৌভাগ্য সবার হয় না। আমি ক্যান্সার রোগীদের অসহনীয় কষ্ট দেখেছি। কারও অর্থ কষ্ট, কারও যত্নের অভাব, কারও সহযোগিতা ও সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই, কারও চিকিৎসাজনিত যন্ত্রণা, কারও মৃত্যু যন্ত্রণা।
কতোরকম কষ্ট! নানারকমের পরীক্ষা, সার্জারি, রেডিয়েশন, ক্যামো, ঔষধ….. এক একটি যন্ত্রণাময় অধ্যায়। একেক জনের একেকরকম। এটি এমন এক রোগ যেখানে মানুষ কোন না কোনভাবে অসহায়। সবকিছু মেনে নিয়ে পরিস্থিতি ও সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে পথ চলতে হয় প্রতিটি ক্যান্সার যোদ্ধাকে। বাইরে থেকে বিষয়টা কতোটা কঠিন বুঝার উপায় নেই কারও। কাছ থেকে দেখলে অনেকটা বোঝা যায় হয়তো। রোগী আর পরিবার জানে প্রতিক্ষণের দুঃশ্চিন্তা, যন্ত্রণাগুলো। ভূক্তভোগী ছাড়া অতোটা সহজ নয় অনুমান।
এ লড়াইয়ে আমি জীবনকে নতুন করে জেনেছি, নতুন করে চিনেছি। আমি আমার ভেতরের শক্তিকে চিনেছি। বিপদের বন্ধু চিনেছি। আমি হারবো না বলে আপ্রাণ লড়েছি। এখন আমার বিশ্বাস মনে, আমি হয়তো জিতে গেছি।
আমি জেনেছি, ক্যান্সারে মৃত্যুটা বড় বিষয় নয়; দীর্ঘ কঠিন লড়াই লড়ে স্বাভাবিক জীবনে থাকতে পারার বিষয়টাই বড়। এটাই বেঁচে থাকা, এটাই জীবন।
দুঃখ লাগে যখন দেখি, ক্যান্সার সম্পর্কে মানুষের ধারণার অভাবে, কুসংস্কার আর জড়তার জন্য, পরিবারের সহযোগিতার অভাবে, সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়ায়, ভুল চিকিৎসায়, যথাযথ চিকিৎসার অভাবে রোগী ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে এসে রোগের কথা জানতে পারে। তখন মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। এটা সত্যি যে, ক্যান্সারের পর্যায় যাই হোক না কেন লড়াইটা কোন পর্যায়েই অতোটা সহজ নয়।
সচেতনতা, চিকিৎসা সবই আমাদের দেশে এখনো অপ্রতুল। তাই ক্যান্সার সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে। সময় থাকতে সচেতন হলে এ রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে।
আসুন আমরা সবাই মানবিক হই, সমব্যথী হই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here