
নিজস্ব প্রতিবেদক :
ছাত্র রাজনীতি, শ্রমিক রাজনীতির দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সত্যিকারের একজন জননেতা হয়ে জনগণের মাঝে স্থান করে নিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। জীবন সায়াহ্নে এসেও আঁকড়ে রেখেছিলেন রাজনীতিকে। চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মানুষকে প্রচন্ড ভালবাসতেন এই পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দব করে মানুষের ভালবাসা নিয়ে একাধিকবার গিয়েছেন জাতীয় সংসদে। মন্ত্রী হিসেবে সরকারের একাধিক দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ভোরে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমান। তাঁর মৃত্যুতে দেওয়া শোকবার্তায় আবদুল্লাহ আল নোমানকে একজন গুণী রাজনীতিবিদ অভিহিত করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সব দলমতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন তিনি।’
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন নোমান। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির একটি সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল তাঁর।
১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম গ্রহণ করেন আবদুল্লাহ আল নোমান। ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন তিনি। পরবর্তীতে মেননপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন নোমান।
ছাত্রজীবন শেষ করার পর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। দায়িত্ব পালন করেন পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবে। ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হন তিনি। ১৯৭০ সালে স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় ইয়াহিয়ার সামরিক আদালতে আবদুল্লাহ আল নোমানকে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ১৪ বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৭০ সালে তাকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ১৫ বছর যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। একসময় চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতির দুই কান্ডারি হিসেবে পরিচিত ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান ও কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীরবিক্রম। চট্টগ্রাম মহানগর ও উত্তর জেলার রাজনীতিতে একক প্রভাব ছিল নোমানের। আর দক্ষিণে ছিল অলির প্রভাব।
চট্টগ্রামের রাউজান ও কোতোয়ালি আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভায় খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের একজন সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
আমির খসরুর শোক : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
এক শোক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালিন সময় থেকে দলকে সুসংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন দল অন্তঃপ্রাণ নেতা। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতীয়তাবাদী দল এক ত্যাগী, সাহসী, সংগ্রামী সজ্জন ও বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদকে হারালো। তার মৃত্যুতে দলের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি নেতা কর্মীদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন।
সিটি মেয়রের শোক : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন।
এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুর সংবাদ আমার জন্য ভীষণ কষ্টের। তার হাত ধরেই আমরা রাজনীতি শুরু করেছি। বিএনপির রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অনন্য এক নেতা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালিন সময় থেকে দলকে সুসংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার একদফার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মহানগর বিএনপির শোক কর্মসূচী : দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে তিন দিনের শোক কর্মসূচী ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- কালো ব্যাজ ধারণ, মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে খতমে কুরআন ও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন।
কর্মসূচীর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বাদে যোহর নাসিমন ভবনস্থ দলীয় কার্যালয় সংলগ্ন মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
শুক্রবার জানাযা : আবদুল্লাহ আল নোমানের জানাযা শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাদে জুমা চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদে এবং বাদে আসর রাউজান গহিরা হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। জানাযা শেষে রাউজান গহিরাস্থ পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন আবদুল্লাহ আল নোমানের একান্ত সচিব নুরুল আজিম হিরু।