
নিজস্ব প্রতিবেদক :
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সুন্নি মতাদর্শী ৩টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বি এস পি) এর সমন্বয়ে ‘বৃহত্তর সুন্নি জোট’ নামে নতুন জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ জোটের ঘোষণা দেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে নবগঠিত এই জোটের ১৭ দফা দাবি ও ২১ দফা ঘোষণাপত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জোটের অন্যতম শরীক দল ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ এর মহসচিব আল্লামা জয়নুল আবেদীন জুবাইর বলেন, বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। যার সীমান্তে অন্য কোন মুসলিম দেশের অবস্থান নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হলেও এটি আউলিয়ায়ে কেরাম এবং সুফি সাধকদের শত শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ফসল। ৯২ শতাংশ মুসলমানের আবাসভূমি এদেশের অধিকাংশই সূফিবাদী আদর্শে উজ্জীবিত সুন্নী মুসলমান। যে দেশের মানুষের সার্বিক জীবনাচরণ, কৃষ্টি- সভ্যতার প্রতিটি পরতে- পরতে দৃশ্যমান হয়ে থাকে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন। তথাপি ইসলামে কোন রাজনীতি নেই এমনটি বলতেও অনেকেই কুন্ঠাবোধ করে না। অনেকেই ইসলামী রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা বলেই অভিহিত করে। মূলতঃ এধরণের অবান্তর, উদ্ভট ও কূপমণ্ডূক ধ্যান-ধারনার প্রচার- প্রসার অব্যাহত রেখে এদেশে মুসলিম উম্মাহকে পশ্চাৎপদ রাখার সুগভীর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী একটি অপশক্তি। অথচ এদেশের সর্বত্র ইসলামী রাজনীতির অনুকূল পরিবেশ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবেই এদেশ হচ্ছে ইসলামী রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র। তাই দেশ ও জাতিকে সর্বপ্রকার মানবগড়া মতবাদের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গিকারে সূন্নী মতাদর্শী ৩ টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল যথাক্রমে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, নিবন্ধন নং- ০৩০, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, নিবন্ধন নং- ০৩৫ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, নিবন্ধন নং- ০৪৯ এর সমন্বয়ে “বৃহত্তর সূন্নী জোট” এর আত্মপ্রকাশ।
তিনি বলেন, বিগত ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র- জনতার অভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। এ অভ্যুত্থানে জাতি,ধর্ম, বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে প্রায় সকলই সমর্থন এবং অংশগ্রহণ করে। যেখানে আত্মাহুতি দিয়েছে অসংখ্য তরতাজা অমূল্য প্রাণ। ছাত্র- জনতার এহেন অমূল্য আত্মত্যাগের প্রতি রইলো আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। অতঃপর আশার সঞ্চার হয় জনমনে। কিন্তু দূঃখজনক হলেও সত্য যে, অন্তর্র্বতী সরকারের ১ বছর অতিবাহিত হতে চললেও অদ্যাবধি জাতীয় জীবনে কোনরূপ সুস্থতা ও স্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, বরং সর্বত্রই অনুভূত হচ্ছে এক বিষ্ফোরোন্মুখ পরিস্থিতি। জ্যামিতিক হারে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে লুটতরাজ, মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজি তথা অবাঞ্ছিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। থামছেই না মসজিদ, মাদরাসা ও মাজারসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর তথা অগ্নিসংযোগের মতো গর্হিত অপরাধ প্রবনতা। সন্দেহের বশিভূত হয়ে গণপিটুনিতে হত্যার মতো অপরাধ ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান তথা বিবিধ পালা-পার্বনে অযাচিত হামলার ঘটনা ঘটছে অবলীলায়। বিশেষতঃ গত বছর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন শোভাযাত্রায় নির্বিচারে হামলা ও হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। উপরন্তু বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার সম্মানীয় শিক্ষক, মসজিদের খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের উপর চড়াও হয়ে তাঁদের ফিল্মি স্টাইলে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটেছে দেশের অসংখ্য জায়গায়। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অযাচিত ঘটনা সংঘটিত হলেও প্রশাসনের নির্বিকার ও নিস্ক্রিয় ভূমিকা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি কলংকিত অধ্যায়। ফলে জনমনে ক্রমাগত উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের প্রতি জনগণের চরম আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে দেশ-জাতির উত্তরণ খুবই জরুরি।
ইতোমধ্যে অন্তর্বতী সরকার কর্তৃক আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এর সময় ঘোষনা করা হয়েছে। আমরা মনে করি আসন্ন এ নির্বাচন জাতীয় জীবনে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘বৃহত্তর সুন্নি জোট’ এর অন্তর্ভুক্ত ৩টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রত্যাশী।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন- ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ এর মহাসচিব অধ্যক্ষ আল্লামা জয়নুল আবেদীন জুবাইর। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন- বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব অধ্যক্ষ আল্লামা স উ ম আবদুস সামাদ। নবগঠিত জোটের তিন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মাওলানা এম এ মতিন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান ছৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান ছৈয়দ সাইফুদ্দীন আল হাসানী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সংবাদ সম্মেলনে মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অধ্যক্ষ আল্লামা এস এম ফরিদ উদ্দীন, আল্লামা আবু সুফিয়ান আবেদী আলকাদেরী, এডভোকেট আবু নাছের তালুকদার, এম সোলায়মান ফরিদ, অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী, আল্লামা খাজা আরিফুর রহমান তাহেরী, আল্লামা মোশাররফ হোসেন হেলালী, মাওলানা আশেকুর রহমান হাশেমী, মাওলানা বাকি বিল্লাহ আজহারী, মাওলানা রুহুল আমিন ভূঁইয়া চাঁদপুরী, স ম হামেদ হোসাইন, এইচ এএম মুজিবুল হক শাকুর, এ এম মঈনউদ্দীন চৌধুরী হালিম, মাওলানা ওয়াহেদ মুরাদ প্রমুখ।
বৃহত্তর সুন্নি জোটের ১৭ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- জাতীয় নীতি নির্ধারনে সকল নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণ ও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করণ, সরকারের দেয়া ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা বাস্তবায়নের পাশাপাশি একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সকল নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে সরকারের প্রভাবমুক্ত রেখে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা, জুলাই আন্দোলনে বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া এবং সকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করা, অবৈধ অর্থ পাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা, নির্বাচনের পূর্বে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা, দুর্নীতিবাজ, আদালতের রায়ে দণ্ডিত সন্ত্রাসী, ঋণখেলাফি, বিদেশে অর্থ পাচারকারী ও কালো টাকার মালিকদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকান্ড, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, বিভিন্ন সেক্টর থেকে লোকজনকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো গর্হিত কাজ বন্ধ করা, এ সবধরণের গুম, খুনসহ বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের বিচার নিশ্চিত করা, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা থেকে ছাঁটাই বন্ধ করা ও ইতিমধ্যে ছাঁটাইকৃতদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করা, নারী কমিশন প্রদত্ত রিপোর্ট বাতিল করা, কোরান সুন্নাহ বিরোধী আইন প্রণয়ন থেকে বিরত থাকা, জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, পুনর্বাসন ও আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, জনগণের সর্বশেষ আস্থার ঠিকানা সেনাবাহিনীকে কোন বিতর্কে না জড়িয়ে এ বাহিনীর গৌরবময় ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন করা, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি ইস্ট ইন্ডিয়া মার্কা কোম্পানীর হাতে তুলে না দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনা করা, মানবিক করিডোরের নামে আরাকানী সন্ত্রাসী গোষ্টিতে দেশের ভূ-খন্ড ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়া, গত এক বছরে ভাংচুরকৃত শতাধিক, মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণে রাষ্ট্রীয় উদোগ গ্রহণ করা ও হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তি নিশ্চিত করা।